আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার বা যকৃৎ। খাওয়া-দাওয়ার পর সবকিছু পরিপাক হয়ে রক্তের মাধ্যমে লিভারে যায়। লিভার এই খাবার থেকে শক্তি উৎপন্ন করে এবং অতিরিক্ত পুষ্টি জমা রাখে। খাবারের চর্বি ভাঙতে লিভার পিত্ত তৈরি করে। রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং কিছু প্রোটিনও লিভার তৈরি করে। আসুন লিভার ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে আজকে আমরা কিছু উপায় জেনে নেই।
লিভারের কিছু সাধারণ সমস্যা হলো জন্ডিস, পিত্তথলিতে পাথর, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার, উইলসন্স ডিজিজ এবং ফ্যাটি লিভার।
কিছু অভ্যাস লিভারের ক্ষতি করে। যেমনঃ-
- অতিরিক্ত মদ্যপান
- বিনা প্রয়োজনে বেশি ওষুধ খাওয়া (ঠান্ডা, জ্বর, ব্যথা, ঘুমের ওষুধ)
- ধূমপান
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
- অপুষ্টিকর খাবার, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া (সকালে না খাওয়া, বেশি তেল-মশলাযুক্ত খাবার, পোড়া তেলের খাবার, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড)
- রাসায়নিকযুক্ত খাবার (প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম রঙ, কৃত্রিম চিনি)
এছাড়াও ভাইরাস, পরজীবী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যা, বংশগত কারণ এবং ক্যানসার লিভারের ক্ষতি করতে পারে। মাদকদ্রব্য (মারিজুয়ানা, কোকেন) লিভারের জন্য অনেক ক্ষতিকর।
লিভার ভালো রাখার উপায় হিসেবে কিছু সহজ টিপস:
১.কম চর্বিযুক্ত খাবারে সাবধান: বাজারে “লো ফ্যাট” বা “৯৯% ফ্যাট-মুক্ত” লেখা খাবারে প্রায়ই চর্বির বদলে প্রচুর চিনি মেশানো থাকে, যা লিভারের জন্য আরও ক্ষতিকর। এই ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন।
২.মানসিক চাপে খাবার নয়: বোর হলে বা ক্লান্ত লাগলে খাবার খেয়ে মন ভালো করার প্রবণতা অনেকেরই থাকে। কিন্তু মানসিক চাপের সময় খাবার হজম ভালোভাবে হয় না, যা লিভারের উপর চাপ বাড়ায়।
৩.প্রাকৃতিক উপাদানের উপকার: ড্যান্ডেলিয়ন, মিল্ক থিসল ও হলুদের মত কিছু গাছের মূল লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
৪.পুষ্টিকর পদার্থ: ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, প্রোটিনে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড লিভারের জন্য ভালো। পুষ্টিকর পদার্থের জন্য সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫.ওষুধে সতর্কতা: কিছু ব্যথানাশক (যেমন টাইলেনল) এবং কোলেস্টেরলের ওষুধ লিভারের ক্ষতি করতে পারে। ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
৬.কফির উপকারিতা: নিয়মিত কফি পান লিভারের রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
৭.বিষাক্ত পদার্থ পরিহার: ত্বকে ব্যবহৃত কিছু স্প্রে বা রাসায়নিক পদার্থ ত্বকের মাধ্যমে রক্তে মিশে লিভারের ক্ষতি করতে পারে। এই ধরনের পদার্থ থেকে দূরে থাকুন।
লিভার সুস্থ রাখার জন্য সঠিক খাবার খাওয়া খুবই জরুরি:
খাবার:
- মাংসের প্রোটিনের চেয়ে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন লিভারের জন্য ভালো। ডাল, শাক-সবজি, বাদাম, আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খান।
- অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
- লিভারের জন্য স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জরুরি। অলিভ অয়েল, আখরোট এর মতো খাবারে ভালো ফ্যাট পাওয়া যায়।
লিভারের সুস্থতা:
- লিভারের মেদ কমাতে হলে আগে ওজন কমাতে হবে। বেশি ক্যালরি, অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট, সাদা পাউরুটি, পাস্তা, চিনি এড়িয়ে চলুন।
- কাঁচা বা আধাসেদ্ধ মাছ-মাংস খাবেন না।
- প্রতিদিন তাজা ফল, শাকসবজি, লাল চাল, সিরিয়াল খান।
- রসুন, জাম্বুরা, গাজর, গ্রিন টি, অ্যাভোকাডো, আপেল, অলিভ অয়েল, লেবু, বাঁধাকপি, হলুদ লিভারের জন্য ভালো
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
- কীটনাশক, রাসায়নিক সার, অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। মশা মারার ওষুধ ব্যবহারের সময় মাস্ক পরুন এবং ঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন।
- রেজর, দাঁতের ব্রাশ, নেইল কাটারের মতো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অন্যের সাথে শেয়ার করবেন না। হেপাটাইটিস এ এবং বি এর টিকা নিন।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না।
লিভারের জন্য উপকারী খাবারগুলো
আমাদের লিভার শরীরের একমাত্র অঙ্গ যা নিজেকে পরিষ্কার করতে পারে। আমরা যা খাই বা পান করি, লিভার সেগুলো থেকে ক্ষতিকর পদার্থ দূর করে। তাই লিভার সুস্থ রাখতে সঠিক খাবার খাওয়া খুব জরুরি। কিছু খাবার লিভারকে প্রাকৃতিকভাবে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
আভোকাডো
আভোকাডো এমনই একটি উপকারী খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেলস এবং গ্লুটাথিয়ন নামক এক ধরণের উপাদান আছে যা ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে লিভারকে সুস্থ রাখে।
রসুন
রসুনও লিভারের জন্য খুব ভালো। এতে থাকা সালফার যৌগ লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। রসুনে থাকা সেলেনিয়াম লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
সবুজ শাকসবজি
পালং শাকের মতো সবুজ শাকসবজিতে ভিটামিন এ, সি, কে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা রক্ত পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
হলুদ
হলুদ লিভারের জন্য খুবই ভালো। এটি লিভারের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, লিভারের কোষগুলোকে সতেজ রাখে এবং পিত্ত উৎপাদন বাড়ায়। হলুদ লিভারে চর্বি জমা হতেও বাধা দেয়, যা ফ্যাটি লিভার এবং লিভার সিরোসিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমায়।
বিট
বিটের রসে নাইট্রেট থাকে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং হৃদরোগ ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বিটে এমন কিছু উপাদান আছে যা ফ্যাটি লিভারের সমস্যা কমাতে পারে।
জলপাই তেল
জলপাই তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা স্ট্রেস কমায় এবং লিভারের জন্য ভালো। এতে ক্ষতিকর চর্বি নেই, তাই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
আখরোট
আখরোটে প্রচুর পুষ্টি, ভিটামিন, ভালো চর্বি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। এতে আর্জিনাইন নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড আছে, যা লিভার পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কালো আখরোট লিভারে রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ
স্যামনের মতো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ লিভারের প্রদাহ কমায় এবং উৎসেচকের ক্ষরণ ঠিক রাখে।
আপেল
আপেলে প্রচুর ফাইবার আছে যা শরীর থেকে টক্সিন বের করে এবং পাচনতন্ত্র ভালো রাখে।
লেবু
গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে লিভার পরিষ্কার হয় বলে মনে করা হয়। পিপ্পলি নামক একটি ভেষজ উদ্ভিদের লিভারের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় উপকারী গুণ আছে।
ওটস
যেসব খাবার ভালো হজমে সাহায্য করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ওটস। ওটসে থাকে প্রচুর ফাইবার। যেসব খাবার হজম ভালো করে, সেগুলো লিভারের জন্যও ভালো। এ ছাড়া, ওটসে থাকা বিটা গ্লুক্যান লিভারকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। যাদের ডায়াবেটিস ও স্থূলতার মতো সমস্যা রয়েছে, তারাও নিয়মিত ওটস খেতে পারেন। কারণ এই দুই অসুখের বিরুদ্ধেও লড়াই করে ওটস।
গ্রিন টি
গ্রিন টি ক্যাটেচিন নামে পরিচিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ। ক্যাটেচিন লিভার ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে এবং লিভারের প্রদাহ কমায়।
কফি
কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে অনেকেরই। পরিমিত কফি খেতে পারলে তা লিভারের সমস্যা থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। সেক্ষেত্রে কফি খেতে হবে দুধ ও চিনি ছাড়া।
২০১৩ সালে আমেরিকায় একটি জরিপে দেখা যায়, সেখানকার প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিদিন কালো কফি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাদের ভেতরে কারো লিভারের কোনো সমস্যা হয়নি। সেই সঙ্গে কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভার ক্যানসারের আশঙ্কাও কমিয়ে দেয়।
Pingback: গলা শুকিয়ে যাওয়ার কারণ ও প্রতিকার - Techguccho