আজকের পোস্টে আমরা জুমার দিনের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করব। আমরা যারা মুসলিম আছি সবাই শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাই কিন্তু এই নামাজ বা জুমার দিনের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে বেশিরভাগ মুসলিমের অজানা।
জুমার দিনের আমল ও ফজিলত
অন্যান্য দিনের তুলনায় জুম্মার দিনকে আমরা সবাই একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বলা হয়ে থাকে, জুম্মার দিন হলো গরিবের হজের দিন। জুম্মার দিন জুম্মার নামাজের জন্য যে যত তাড়াতাড়ি মসজিদে আসবে সে তত বেশি সওয়াব পাবে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যখন জুম্মার দিন আসে, ফেরেশতারা মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে আগন্তুকদের নাম লিখতে থাকে। যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি উট সদকা করে। তারপর যে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি গাভী সদকা করে। তারপর আগমনকারী মুরগি সদকাকারীর মতো। তারপর আগমনকারী একটি ডিম সদকাকারীর মতো। এরপর যখন ইমাম খুতবা দিতে বের হন, তখন ফেরেশতারা তাদের দফতর বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনতে থাকেন। (বুখারি : ৮৮২)
ইসলামের দৃষ্টিতে জুম্মার দিনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পবিত্র জুম্মা ও জুম্মাবারের রাত-দিন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। জুম্মার দিনের সওয়াব ও মর্যাদা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতোই। এই দিন ইসলামী ইতিহাসে বড় বড় ও মহৎ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তাই মুসলিমরা এই দিনটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। জুম্মার দিনকে অনেক মুসলিম গরিবের ঈদের দিন বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
জুম্মার দিনে প্রায় মসজিদে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি মুসল্লির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তাছাড়া এই দিনটিতে মানুষ তার বিভিন্ন মান্নতের জিনিসপত্র দান করে থাকে। জুম্মার দিনকে কেন্দ্র করে মুসল্লিদের প্রদান করা মিস্ত্রি বিরত করা হয়।
মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, জুম্মার দিন দোয়া কবুল হওয়ার একটি সময় আছে, কোনো মুসলিম যদি সেই সময়টা পায়, আর তখন যদি সে নামাজে থাকে, তাহলে তার যেকোনো কল্যাণ কামনা আল্লাহ পূরণ করেন। (বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৪০০)
জুম্মার গুরুত্ব
জুম্মার গুরুত্ব আল্লাহ তাআলার কাছে এত বেশি যে, কোরআনে ‘জুম্মা’ নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! জুম্মার দিন যখন নামাজের আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) এগিয়ে যাও এবং বেচাকেনা (দুনিয়াবি যাবতীয় কাজকর্ম) ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে।” (সূরা জুমা- ৯)। রাসুল (সাঃ) একটি হাদিসে বলেছেন, “মুমিনের জন্য জুম্মার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ১০৯৮)। এক হাদিসে নবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “যে দিনগুলোতে সূর্য উদিত হয়, ওই দিনগুলোর মধ্যে জুম্মার দিন সর্বোত্তম। ওই দিন হজরত আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করা হয়েছে।”
ওই দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ওই দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর ওই দিনই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ৮৫৪) জুমার নামাজ (আরবি: সালাত আল-জুমুআহ, “শুক্রবারের সালাত”) ইসলামের অন্যতম একটি নামাজ। মুসলিমদের জন্য বিশেষ দিন এই দিনটি। মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার দিন। একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করার দিন। جُمُعَة (জুমুআহ) শব্দটি আরবি, এর অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া। যেহেতু, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুক্রবারে প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন-মুসলমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে একত্রিত হয়ে জামাতের সাথে সেদিনের জোহরের নামাজের পরিবর্তে এই নামাজ ফরজরূপে আদায় করে, সেজন্য এই নামাজকে “জুমার নামাজ” বলা হয়। সময় একই হলেও জোহরের সাথে জুমার নামাজের নিয়মগত কিছু পার্থক্য রয়েছে।
আরো পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
জুমার দিনের বিশেষ আমল
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো, কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। (আবু দাউদ, হাদিস নং ১০৪৭)।
এমনিতেই তিরমিজি শরিফের হাদিস অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, যে ব্যক্তি দরুদ পাঠ করে আল্লাহ তার ওপর দশটি রহমত নাযিল করেন। সুতরাং আমাদের জুমার দিন অন্যান্য আমলের সঙ্গে সঙ্গে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে হবে। জুমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই দিনটিকে কাজে লাগানো।
জুমার নামাজের নিয়ম
জুমার নামাজে দুই রাকাত ফরজ রয়েছে। এছাড়া ফরজ নামাজের পূর্বে চার রাকাত কাবলাল জুমা এবং পরে চার রাকাত বাদাল জুমা (সুন্নত নামাজ) আদায় করতে হয়। জোহরের নামাজের মতো ব্যক্তি চাইলে এ সময় অতিরিক্ত নফল নামাজ আদায় করতে পারে। তবে এসকল নফল নামাজ জুমার অংশ হিসেবে পড়া হয় না এবং তা আবশ্যকীয়ও নয় বরং ব্যক্তি তা স্বেচ্ছায় করতে পারে এবং না করলে তার দোষ হয় না।
জুম্মার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা আবশ্যিক এবং তা একাকী আদায় করার নিয়ম নেই। কুরআনে জুমার নামাজের সময় হলে কাজ বন্ধ করে নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো ব্যক্তি যদি যুক্তিসঙ্গত কারণবশত (যেমন, খুব অসুস্থ ব্যক্তি) জুমার নামাজ আদায় করতে না পারে, তবে তার ক্ষেত্রে জোহরের নামাজ আদায় করা নিয়ম।
তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সুস্থ ব্যক্তির উপরও, যেমন ভ্রমণকারী (মুসাফির) অবস্থায়, জুমার আবশ্যকতা থাকে না এবং সেক্ষেত্রে জোহরের নামাজ আদায় করলে তা গ্রহণীয় হয়। তবে ভ্রমণকারী চাইলে জুমা আদায় করতে পারে।
দোয়া কবুলের দিন জুমা
জুমা দিনের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যখন দোয়া করলে তা কবুলের আশা করা যায়। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে—
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনের যে মুহূর্তে (দোয়া কবুল হওয়ার) আশা করা যায়, তা আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে তালাশ করো।’ (তিরমিজি, মুসলিম, মিশকাত, তালিকুর রাগিব)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কখন?
জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সময় এ সম্পর্কে ৪৫টি মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। এ সময়টিতে দোয়া করলে তা কবুল হয়, যা হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সে সময়টি হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, তিরমিজি)
সূরা কাহফ তিলাওয়াতের আমল
- হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য এক জুমা থেকে অপর (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত নূর হবে।
- হযরত আলি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, সে আট দিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকেও মুক্ত থাকবে।
- অন্য রেওয়ায়েতে আছে, এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে উল্লিখিত গুনাহ মাফ হওয়ার দ্বারা সগিরা গুনাহ উদ্দেশ্য। কারণ ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হচ্ছে যে, কবিরা গুনাহ তওবা করা ছাড়া ক্ষমা হয় না।
তবে যদি কেউ পুরো সূরা তিলাওয়াত করতে না পারে তবে ন্যূনতম সূরাটির প্রথম ও শেষ ১০ আয়াত তিলাওয়াত করায়ও রয়েছে এ সব বিশেষ ফজিলত। মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক উৎসবের দিন শুক্রবার। জুমার নামাজের ফজিলত অপরিসীম। দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদাসম্পন্ন। এই দিনের বিশেষ কিছু আমল ও ফজিলত রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! জুমার দিন যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে এসো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো, এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। এরপর নামাজ শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমা : ৯-১০)
জুমার দিনে হাদিসে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো
- গোসল করা
- ফজরের ফরজ নামাজে সূরা সাজদা ও সূরা দাহর/ইনসান তিলাওয়াত করা
- উত্তম পোশাক পরা
- সুগন্ধি ব্যবহার করা
- আগেভাগে মসজিদে যাওয়া
- সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা
- রাসুল (সা.) এর ওপর সারাদিন যথাসম্ভব বেশি দরূদ পাঠ করা
- মসজিদে গিয়ে কমপক্ষে দুই রাকাত সুন্নত আদায় করা
- ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসা
- দুই খুৎবার মাঝের সময়ে বেশি বেশি দোয়া করা
- অন্য সময়ে দোয়া করা। কারণ এদিন দোয়া কবুল হয়।
- মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনা। খুৎবা চলাকালে কোনো কথা না বলা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জুমার দিন এসব আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
Pingback: দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ - Techguccho
Pingback: কবর জিয়ারতের দোয়া - Techguccho