ব্রণের সমস্যা আপনার ত্বকে আরও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। নাছোড়বান্দা ব্রণ একবার দেখা দিলে সহজে দূর হতে চায় না। এক্ষেত্রে নানাজন নানা ধরনের উপায় বেছে নেন। তবে কেমিক্যালযুক্ত বিভিন্ন প্রসাধনীর বদলে বেছে নিতে পারেন ঘরোয়া উপায়। ঘরোয়া উপায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ। তবে সঠিক উপায় জানা থাকা চাই। এতে সুফল পাবেন সহজেই।
ব্রণের কারণ
নানা কারণে ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে এই সমস্যা দেখা দেয়। আবার যাদের ত্বক তৈলাক্ত ধরনের, তাদের ক্ষেত্রে ব্রণের সমস্যা বেশি হতে পারে। আমাদের ত্বকে যখন অতিরিক্ত পরিমাণে সেবাম উৎপাদন হয় তখন ত্বকরন্ধ্র বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সেখানে ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্রণ দেখা দেয়।
ব্রণের প্রকারভেদ
১. ট্রপিক্যাল একনে অতিরিক্ত গরম এবং আর্দ্রতায় পিঠে, উরুতে বেশি হয়ে থাকে।
২. প্রিমেনস্ট্রুয়াল একনে নারীদের মাসিকের সপ্তাহখানেক আগে ওঠে।
৩. একনে কসমেটিকার কোনো কোনো প্রসাধনী লাগাতার ব্যবহারের কারণে হতে পারে।
৪. মুখ বারবার সাবান দিয়ে ধুলেও (দৈনিক ১ থেকে ২ বারের বেশি) ব্রণের পরিমাণ বেড়ে যায়। একে একনে ডিটারজিনেকস বলে।
৫. স্টেরয়েড একনে স্টেরয়েড ওষুধ সেবন বা ব্যবহারে দেখা দেয়।
ব্রণ হলে কী করবেন?
- দিনে দু-তিনবার হালকা সাবান বা ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুতে হবে। বাইরে থেকে এসেই মুখ ধুয়ে ফেলুন। এ ছাড়া হালকা গরম পানির স্টিম নিতে পারেন।
- তেল ছাড়া ওয়াটার-বেজড মেকআপ ব্যবহার করুন।
- মাথা খুশকিমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং আলাদা তোয়ালে ব্যবহার করুন।
- রাতে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি খান ও পানি পান করুন।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে হবে। প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
ব্রণ হলে যা করবেন না:
- রোদ এড়িয়ে চলুন।
- তেলযুক্ত ক্রিম বা ফাউন্ডেশন ব্যবহার করবেন না।
- ব্রণে হাত লাগাবেন না, খুঁটবেন না।
- চুলে এমনভাবে তেল দেবেন না, যাতে মুখটাও তেলতেলে হয়ে যায়।
- তেলযুক্ত বা ফাস্টফুড খাবার ও উচ্চ শর্করাযুক্ত খাবার পরিহার করুন।
তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ
ব্রণ দূর করার জন্য প্রথমে মুখের অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন নিয়ম করে মুখ পরিষ্কার করাও। যত কিছুই ব্যবহার করুন না কেন, মুখ যদি পরিষ্কার না থাকে তাহলে কোনো লাভ মিলবে না। তাই সবার আগে মুখের তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
চন্দন ব্যবহার
চন্দনের রয়েছে অনেক গুণ। ত্বক ভালো রাখতে এটি বিশেষভাবে কার্যকরী। ব্রণের সমস্যা দূর করতে চাইলে চন্দন ব্যবহার করতে পারেন। এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রণ দূর করতে সাহায্য করবে। চন্দনের সঙ্গে সামান্য গোলাপজল মিশিয়ে ব্রণে লাগান। এতে উপকার পাবেন।
হলুদের ব্যবহার
ত্বকের যত্নে হলুদের উপকারিতার কথা সবারই জানা। ব্রণ দূর করার ক্ষেত্রেও হলুদ অত্যন্ত কার্যকরী। হলুদের সঙ্গে সামান্য চন্দন এবং পানি মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই মিশ্রণ নিয়মিত ব্যবহার করলে ব্রণ থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
নিমের পেস্ট ব্যবহার
নিমপাতা নানা ধরনের সংক্রমণ রোধে কাজ করে। এই পাতার তৈরি পেস্ট ব্রণের উপর লাগালেও মিলবে উপকার। আবার চাইলে এর সঙ্গে অ্যালোভেরাও যোগ করতে পারেন। নিমপাতার সঙ্গে অ্যালোভেরা যোগ করে নিন ভালোভাবে। এরপর সেই মিশ্রণ ত্বকে লাগিয়ে নিন।
তুলসী পাতার ব্যবহার
তুলসী পাতা কেবল শরীর সুস্থ রাখতেই কাজ করে না, এটি ত্বক ভালো রাখতেও কাজ করে। ব্রণের সমস্যা দূর করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন এই পাতা। তুলসী পাতা বেটে নিন। এরপর তার সঙ্গে সামান্য গোলাপজল মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি আপনার মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর ধুয়ে নিন। নিয়মিত এভাবে ব্যবহার করলে উপকার পাবেন।
মুলতানি মাটি
ত্বকে অতিরিক্ত তেলতেলে ভাবের ফলে ব্রণের সমস্যা দেখা দেয়। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে মুখে মুলতানি মাটি পানি দিয়ে পেস্ট করে লাগাতে পারেন। মুলতানি মাটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে।
শশার রস
শশার রস তৈলাক্ততা দূর করতে খুবই কার্যকর। প্রতিদিন বাইরে থেকে এসে শশার রস দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে পারেন। কিংবা আইস কিউব করে রেখেও ব্যবহার করতে পারেন, এতে ওপেন পোরসের সমস্যাও অনেকটা সমাধান হবে।
শশার রস, চালের গুঁড়া ও মধু
শশার রস মুখে ব্রণ দূর করতে খুবই কার্যকর। এছাড়া স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে এর সঙ্গে চালের গুঁড়া মিশিয়ে নিলেই হবে। যাদের মধুতে অ্যালার্জি নেই, তারা সামান্য মধুও মিশিয়ে নিতে পারেন এই মিশ্রণে। সপ্তাহে দুই দিন এই প্যাক ব্যবহার করলে ত্বক পরিষ্কার হবে। ব্ল্যাকহেডস ও হোয়াইটহেডস দূর হয়ে যাবে। খেয়াল রাখতে হবে, ব্রণ থাকলে স্ক্রাব করা যাবে না।
আপেল এবং মধুর মিশ্রণ
আপেল এবং মধুর মিশ্রণ হচ্ছে ব্রণের দাগ দূর করার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া পদ্ধতি। প্রথমে আপেলের পেস্ট তৈরি করে তাতে ৪-৬ ফোঁটা মধু মিশাতে হবে। মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এরপর মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি ত্বকের টানটান ভাব বজায় রাখে এবং গায়ের রং হালকা করে। সপ্তাহে ৫-৬ বার এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনি কয়েকদিনের মধ্যে পরিবর্তনটা অনুভব করতে পারবেন।
দারুচিনি গুঁড়া ও গোলাপজল
গোলাপজলের নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ কমে যায়। দারুচিনি গুঁড়ার সাথে গোলাপজল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট ব্রণের ওপর লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এতে ব্রণের সংক্রমণ, চুলকানি এবং ব্যথা অনেকটাই কমে যাবে।
ডিমের সাদা অংশ
রাতে শোয়ার আগে ডিমের সাদা অংশ ব্রণ আক্রান্ত জায়গায় ম্যাসাজ করে সারারাত রাখতে পারেন। এটি আপনার ত্বকের খসখসে ভাব দূর করে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এর সাথে লেবুর রস যোগ করা যায়। আপনি এটি আধ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলতে পারেন।
পেঁপে ও চালের গুঁড়ো
ব্রণ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো অপরিষ্কার ত্বক। তাই ত্বক রাখতে হবে পরিষ্কার। নিয়মিত স্ক্রাবিং ত্বককে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। পাকা পেঁপে চটকে নিন এক কাপ। এর সাথে মেশান এক টেবিল চামচ পাতিলেবুর রস এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চালের গুঁড়ো। মিশ্রণটি মুখসহ পুরো শরীরে লাগান। ২০-২৫ মিনিট মাসাজ করে গোসল করে ফেলুন। পেঁপে ছাড়াও ব্যবহার করতে পারেন ঘৃতকুমারীর রস।
পুদিনা পাতা
অতিরিক্ত গরমের কারণে ত্বকে যেসব ফুসকুড়ি এবং ব্রণ হয়, সেগুলো দূর করতেও পুদিনা পাতা উপকারী। টাটকা পুদিনা পাতা বেটে ব্রণের ওপর লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট, এরপর ধুয়ে ফেলুন।
স্পেশাল প্যাক
রক্তচন্দন পাউডার এবং আনারের খোসার গুঁড়ো মিশিয়ে ভালো করে মিলিয়ে নিন। এই মিশ্রণের মধ্যে দুই চামচ দুধ বা টক দই দিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পর ধুয়ে নিন। এই প্যাকটি নিয়মিত মুখে লাগান। ত্বকের জেল্লা বাড়বে। ব্রণের দাগও দূর হয়ে যাবে।
ব্রণ ও ব্রণের দাগ থেকে মুক্তি পেতে কিছু টিপস
- প্রতিদিন ৯-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- প্রতিদিন রাতের খাবারের পর যেকোনো ধরনের মৌসুমি ফল খান। এটি আপনার ত্বককে সতেজ রাখবে। যতটা সম্ভব তেলযুক্ত বা ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার করুন।
- সব সময় বাইরে থেকে আসামাত্র মুখ ফেসওয়াশ দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এছাড়া হালকা গরম পানির স্টীম নিতে পারেন। এতে ত্বকে জমে থাকা ধুলোবালি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
- আমাদের মধ্যে অনেকেরই নখ দিয়ে ব্রণ খোঁটার বাজে অভ্যাস রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে এটা কোনো সমাধান নয়। উল্টো এতে ব্রণের অবস্থা আরও খারাপ হবে। এর ফলে ব্রণ লাল হয়ে যাবে। এমনকি তা ফেটে গিয়ে মুখে দাগের সৃষ্টি করবে। ব্রণ না যাওয়া পর্যন্ত মেক-আপ ব্যবহার না করাই উচিত। দিনে অন্তত দুইবার তেল-মুক্ত ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হবে।
যারা বহুদিন যাবৎ ব্রণ ও ব্রণের দাগের সমস্যায় ভুগছেন, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, তারা আর দেরি না করে কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। তবে ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর করতে উপরে বর্ণিত ঘরোয়া টিপস ও উপায়সমূহ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন আগে।